ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে, পদার্থবিজ্ঞান সম্পর্কে যা জানা দরকার তার অধিকাংশই তারা জেনে ফেলেছেন। নিউটনের গতিসূত্র ও তাঁর বিশ্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র, তড়িৎ বিজ্ঞান ও চৌম্বক বিজ্ঞানকে একত্রিত করে ম্যাক্সওয়েলের তাত্ত্বিক কাজ এবং তাপগতিবিদ্যার সূত্র এবং গতি তত্ত্ব অনেক বৈচিত্র্যময় প্রতিভাসের ব্যাখ্যায় সফলতা লাভ করেছে। বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে দুটি তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের জগৎকে কাঁপিয়ে দেয়। এগুলো হলো ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক প্রদত্ত কোয়ান্টাম তত্ত্ব এবং ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন প্রদত্ত আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব। দুটি ধারণাই প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিতে সুগভীর প্রভাব ফেলেছে। কয়েক দশকের সাধনায় এই তত্ত্বগুলো পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান, নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান এবং ঘনীভূত পদার্থের পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়ন, বিকাশ ও তত্ত্বকে প্রেরণা জোগায়।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সূচনা তাই ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই তত্ত্বের সাহায্যে তিনি কালো বস্তুর বিকিরণের শক্তি কোয়ান্টায়নের কথা বলেন। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আরেকটি বিপ্লব আনেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব ও আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রবর্তনের মাধ্যমে।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা হলো কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান, আপেক্ষিকতা তত্ত্ব, পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞান, নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান, পরিসাংখ্যিক (Statistical) বলবিজ্ঞান, কঠিনাবস্থার পদার্থবিজ্ঞান (Solid state physics) প্রভৃতি।
স্থিতি ও গতি দুটি আপেক্ষিক পদ। যে কোনো গতির বর্ণনার জন্য একটি প্রসঙ্গ কাঠামো প্রয়োজন যার সাপেক্ষে গতি বিবেচনা করা হয়। গতিশীল কোনো বস্তুর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন হয় কোনো না কোনো স্থানাঙ্ক ব্যবস্থা। এই স্থানাঙ্ক ব্যবস্থাকে বলা হয় প্রসঙ্গ কাঠামো ।
অন্য কথায় বলা যায়, যে দৃঢ় বস্তুর সাপেক্ষে ত্রিমাত্রিক স্থানে কোনো বিন্দুকে সুনির্দিষ্ট করা হয় তাকে প্রসঙ্গ কাঠামো বলে। যে কোনো রাস্তা, পার্ক, পৃথিবীপৃষ্ঠ, সূর্য, ছায়াপথ, কোনো বিন্দু, যে কোনো কিছুকে প্রসঙ্গ কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, তবে এদের সবসময়ই সুনির্দিষ্ট করতে হবে।
জড় প্রসঙ্গ কাঠামোকে গ্যালিলীয় প্রসঙ্গ কাঠামো বা নিউটনীয় প্রসঙ্গ কাঠামোও বলা হয়। এই প্রসঙ্গ কাঠামোতে নিউটনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় গতিসূত্র খুব ভালো খাটে। একে অন্য কথায় এভাবে বলা যায়, জড় প্রসঙ্গ কাঠামো হলো সে প্রসঙ্গ কাঠামো যার মধ্যে নিউটনের গতিসূত্র অর্জন করা যায়। এরা পরস্পরের সাপেক্ষে ধ্রুব বেগে গতিশীল। চিত্র ৮.১- এ জড় প্রসঙ্গ কাঠামো দেখানো হয়েছে।
পরস্পরের সাপেক্ষে ধ্রুব বেগে গতিশীল যে সকল প্রসঙ্গ কাঠামোতে নিউটনের গতিসূত্র অর্জন করা যায়। তাদেরকে জড় প্রসঙ্গ কাঠামো বলে।
তরঙ্গ সঞ্চালনের জন্যে মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। দৃশ্যমান তরঙ্গসমূহ যেমন পানি তরঙ্গ, টানা তারে সৃষ্ট তরঙ্গ মাধ্যম ছাড়া সঞ্চালিত হতে পারে না। এমনকি শব্দ তরঙ্গও মাধ্যম ছাড়া চলতে পারে না। সূর্য থেকে যে আলো আমাদের পৃথিবীতে আসে তাকে কোটি কোটি কিলোমিটার মহাশূন্যের মধ্য দিয়ে আসতে হয়, সেখানে তাহলে আলো কীভাবে চলে? বিজ্ঞানীরা সেখানে একটি মাধ্যমের কল্পনা করেন যার নাম দেওয়া হয় ইথার। ইথার হলো এমন একটা মাধ্যম যা মুক্তস্থানে তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গের সঞ্চালনের জন্যে প্রয়োজনীয় বলে বিজ্ঞানীরা মনে করতেন। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান যুগের পদার্থবিদদের পক্ষে এটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে, মাধ্যম ব্যতীত তরঙ্গ সঞ্চালিত হতে পারে। তাড়িতচৌম্বকীয় তরঙ্গ সঞ্চালনের কোনো মাধ্যম নেই বলে পদার্থবিদগণ ইথারের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেন এবং অনুমান করেন যে, ইথারকে সাধারণভাবে আবিষ্কার করা যায় না।
একটি একরঙা আলোক উৎস S থেকে আগত আলোক রশ্মি একটি অর্ধস্বচ্ছ কাচপাত P এর উপর আপতিত হয়। কাচপাত P আপতিত রশ্মির সাথে 45° কোণে রাখা হয়। আপতিত রশ্মি কাচপাত P দ্বারা দুভাগে বিভক্ত হয় (চিত্র ৮.২)।
প্রতিফলিত অংশ আপতিত রশ্মির সমকোণে চলে B অবস্থানে রাখা M1 সমতল দর্পণে লম্বভাবে আপতিত হয় এবং প্রতিফলনের পর P পাতে ফিরে আসে এবং P পাতে প্রতিসরণের পর টেলিস্কোপ T-তে প্রবেশ করে। সঞ্চালিত অংশ আপতিত রশ্মির আদি দিক বরাবর চলে A অবস্থানে রাখা M2 দর্পণে লম্বভাবে আপতিত হয়ে প্রতিফলিত হয় এবং P পাতে ফিরে আসে । P পাতের নিচের পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত হয়ে টেলিস্কোপ T-তে প্রবেশ করে। প্রতিফলিত রশ্মি দুটির ব্যতিচারের দরুন ব্যতিচার ঝালর সৃষ্টি হয় যা T টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায়। যে রশ্মিটি ওপরের দিকের M2 দর্পণে প্রতিফলিত হয় সেটি P পাতের পুরুত্বকে তিনবার অতিক্রম করে আর যে রশ্মিটি M2 দর্পণে প্রতিফলিত হয় সেটি P পাতকে একবার অতিক্রম করে। P পাত থেকে দর্পণ M1 ও M2 এর কার্যকর দূরত্ব একই রাখার জন্য সমতা বিধানকারী পাত P1 ব্যবহার করা হয়।
সমগ্র যান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে পারদের ওপর ভাসমান রাখা হয়। একটি বাহুকে (PA) সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণনের দিকবর্তী রাখা হয় এবং অন্য বাহুটিকে (PB) এই গতির দিকের সাথে সমকোণে রাখা হয়। রশ্মি দুটির গতিপথ এবং তাদের প্রতিফলক পৃষ্ঠ M1 ও M2 এর অবস্থান ভাঙ্গ ভাঙ্গা রেখা দিয়ে দেখানো হলো।
ধরা যাক, স্থির ইথারের সাপেক্ষে PA বরাবর যন্ত্রটি তথা পৃথিবীর বেগ v। PA বরাবর ভ্রমণরত আলোক রশ্মির আপেক্ষিক বেগ (c - v) এবং প্রতিফলিত রশ্মির আপেক্ষিক বেগ (c + v)।
ধরা যাক, PA = PB = d
আলোকরশ্মির P থেকে A-তে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় সময় =
আলোক রশ্মির A থেকে P-তে পৌঁছতে প্রয়োজনীয় সময় =
আলোক রশ্মির P থেকে A-তে যেয়ে পুনরায় P-তে ফিরে আসতে মোট সময়,
… (8.1)
এখন P থেকে B-তে গমনকারী ঊর্ধ্বমুখী আলোক রশ্মিটি বিবেচনা করা যাক। পপৃথিবীর গতির জন্য এটি M1 দর্পণে আপতিত হবে B এর পরিবর্তে B' অবস্থানে। আলোক রশ্মির P থেকে যাত্রা শুরু করে M1 দর্পণে পৌঁছতে যদি t1 সময় লাগে তাহলে PB' = ct1 এবং BB' =vt1
এখন, P B'P' = PB' + B' P' = 2 P' B' যেহেতু PB' = B' P'
(PB')2 = PC2 + (CB)2 = (BB')2 + PB2
:- সম্পূর্ণ PB'P' পথ অতিক্রমের জন্য আলোকরশ্মির মোট প্রয়োজনীয় সময়
স্পষ্টত: t' সময়ে আলোকরশ্মি কর্তৃক অতিক্রান্ত দূরত্ব = এটি হচ্ছে আপতিত রশ্মির দুটি অংশের মধ্যে পথ পার্থক্য। এখন যন্ত্রটিকে 90° কোণে ঘুরিয়ে দিলে আপতিত আলোক রশ্মির দুটি অংশের মধ্যে পথ পার্থক্য পাওয়া যাবে । এই পথ পার্থক্যের কারণে টেলিস্কোপে ব্যতিচার ডোরার কিছু অপসরণ পরিলক্ষিত হওয়ার কথা। মাইকেলসন ও মোরলে এই অপসরণ আশা করেছিলেন 0.4 । তাঁরা ধারণা করেছিলেন যে, তাঁরা 0.01 পর্যন্ত অপসারণ পরিমাণে সক্ষম হবেন। কিন্তু পরীক্ষায় তাঁরা কোনো ডোরা অপসরণ মাপতে সক্ষম হননি অর্থাৎ ব্যতিচার ডোরার কোনো অপসারণ ঘটেনি । মাইকেলসন ও মোরলে ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন ঋতুতে এই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করেন কিন্তু প্রতি বারই তারা ডোরা অপসরণ পরিমাপে ব্যর্থ হন। অর্থাৎ পরীক্ষা থেকে কোনো পর্যবেক্ষণযোগ্য ডোরা অপসরণ পরিলক্ষিত হয়নি। সুতরাং সিদ্ধান্তে আসা যায়, আলোর পথের পরিবর্তন ঘটালেও আলোর দ্রুতি পরিবর্তিত হয়নি। এ থেকে এটিও প্রমাণিত হয় যে, আলোর দ্রুতি একটি সার্বজনীন ধ্রুবক। উপরিউক্ত পরীক্ষা থেকে তাঁরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এ মহাবিশ্বে ইথার নামক কল্পিত পদার্থের কোনো অস্তিত্ব নেই। পরীক্ষার ফলাফল
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞান জগতে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। আর এ নতুন যুগের সূচনা করেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রবর্তনের মাধ্যমে। চিরায়ত বলবিজ্ঞানের মতে স্থান, কাল এবং ভর ধ্রুব। আইনস্টাইন এগুলো সম্পর্কে চিরায়ত বলবিজ্ঞানের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, স্থান, কাল এবং ভর এগুলো পরম কিছু নয়; এগুলো আপেক্ষিক। সুতরাং আইনস্টাইনের এ তত্ত্বকে বলা হয় আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। আপেক্ষিকতা তত্ত্বটি দুটো ভাগে বিভক্ত। এগুলো হলো :
নিউক্লিয় ও পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের বিকাশের জন্য অপরিহার্য এবং বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বৃহত্তম তত্ত্ব আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের প্রবর্তন করেন আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে। গতিবিজ্ঞানের সূত্র, স্থান, কাল এবং ভরের আপেক্ষিকতার বৈজ্ঞানিক মতবাদ এবং এ মতবাদ থেকে আইনস্টাইনের সিদ্ধান্তসমূহ আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব নামে পরিচিত। আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের কথা আইনস্টাইন বলেন আরো এক দশক পরে ১৯১৫ সালে। সার্বিক তত্ত্বে তিনি গ্রহ, নক্ষত্র, ধূমকেতু ইত্যাদির গতি, অভিকর্ষ এবং এ মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কিত তাঁর বৈজ্ঞানিক এবং দার্শনিক মতবাদ ব্যক্ত করেন।
আপেক্ষিকতা তত্ত্বের যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে আজকের নিউক্লিয় যুগের সূচনা হয়েছিল তা হলো ভরের আপেক্ষিকতা অর্থাৎ গতির সাথে ভরের পরিবর্তন এবং ভরকে শক্তিতে রূপান্তর। আইনস্টাইনের মতে, ভর এবং শক্তির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এরা একই সত্তার দ্বৈত প্রকাশ। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিস্ময়কর অবদান ভরশক্তি সম্পর্ক, E = mc2-এর অর্থ হলো কোনো পদার্থে যে শক্তি নিহিত থাকে তা তার ভর এবং আলোর বেগের বর্গের গুণফলের সমান। সুতরাং সামান্য পরিমাণ ভরের মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রচুর শক্তি।
আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব দুটি মৌলিক স্বীকার্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলো হলো-
ব্যাখ্যা: ধরা যাক, S' কাঠামো S- কাঠামোর সাপেক্ষে X - অক্ষ বরাবর v দ্রুতিতে গতিশীল (চিত্র ৮.৩)। S কাঠামোতে নিউটনের গতির দ্বিতীয় সূত্রটি হলো = m। S' কাঠামোতে এই সূত্রটির রূপ হবে
প্রথম স্বীকার্যের মতে পদার্থবিজ্ঞানের
সূত্রগুলো পরম, সার্বজনীন এবং সকল জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর পর্যবেক্ষকের নিকট একই। এক জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর পর্যবেক্ষকের নিকট এই সূত্রগুলো খাটলে অপর জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর পর্যবেক্ষকের জন্যও খাটবে।
দ্বিতীয় স্বীকার্য : দ্বিতীয় স্বীকার্যকে বলা হয় আলোর দ্রুতির ধ্রুবতার নীতি। স্বীকার্যটিকে নিম্নোক্তভাবে বিবৃত করা যায়
বিবৃতি : শূন্যস্থানে সকল জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে আলোর দ্রুতি c এর মান একই।
ব্যাখ্যা : দ্বিতীয় স্বীকার্যে বিবৃত বিষয়টি আমাদের সাধারণ জ্ঞান ও দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার পরিপন্থী এবং একে মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর।
মনে করা যাক, তিনজন পর্যবেক্ষক O1, O2 ও O3 যথাক্রমে তিনটি জড়প্রসঙ্গ কাঠামো S1, S2 ও S3 তে রয়েছেন।
কাঠামো S2, S1 থেকে c/4 দ্রুতিতে দূরে সরে যাচ্ছে এবং S3, S1 এর দিক c/4 দ্রুতিতে এগিয়ে আসছে। S1 জড় প্রসঙ্গ কাঠামোর পর্যবেক্ষক O1, একটি আলোক ঝলক নিঃসরণ করলেন এবং আলোর দ্রুতি পরিমাপ করলেন । যেহেতু O2, O1 থেকে c/4 দ্রুতিতে দূরে চলে যাচ্ছেন, সুতরাং আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা অনুসারে পর্যবেক্ষক O2 এর আলোর দ্রুতি পরিমাপ করার কথা এবং O3 এর আলোর দ্রুতি পরিমাপ করার কথা । কিন্তু দ্বিতীয় স্বীকার্য অনুসারে এটা সম্ভব নয় । সকলেই আলোর দ্রুতি c পরিমাপ করবেন।
ধরা যাক, শূন্যস্থানে S' কাঠামো S-কাঠামোর সাপেক্ষে X-অক্ষ বরাবর দ্রুতিতে গতিশীল। S কাঠামোতে একটি আলোক শিখা প্রজ্বলিত হলো (চিত্র ৮.৪)। S-কাঠামোর একজন পর্যবেক্ষক আলোর দ্রুতি পরিমাপ করলেন c এবং S'- কাঠামোর একজন পর্যবেক্ষক আলোর দ্রুতি পরিমাপ করলেন । এই স্বীকার্য অনুসারে, c = c' হবে। অর্থাৎ উভয়েই আলোর দ্রুতি একই পরিমাপ করবেন। এই স্বীকার্য অনুসারে আলোর দ্রুতি সার্বজনীন ধ্রুবক ।
চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের যে সকল সমীকরণ পরস্পরের সাপেক্ষে ধ্রুববেগে গতিশীল দুটি প্রসঙ্গ কাঠামোর সময় ও স্থানাঙ্কের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের গ্যালিলীয় রূপান্তরও বলা হয়। একে নিউটনের রূপান্তরও বলা হয়।
গ্যালিলীয় রূপান্তর এর সমীকরণগুলোকে নিম্নোক্তভাবে বের করা যেতে পারে।
ধরা যাক, S এবং S' দুটি জড় প্রসঙ্গ কাঠামো। S´ কাঠামোটি S এর সাপেক্ষে X অক্ষের দিকে v ধ্রুব বেগে গতিশীল।
ধরা যাক, P বিন্দুতে একটি ঘটনা সংঘটিত হলো। মনে করা যাক, S এ অবস্থানরত একজন পর্যবেক্ষক O এই কাঠামোতে । সময়ে সংঘটিত এই ঘটনার স্থানাঙ্ক পর্যবেক্ষণ করলেন x, y, z। এখন S এ অবস্থিত অন্য পর্যবেক্ষক O' দেখতে পাবেন একই ঘটনা t´ সময়ে ঘটেছে এবং তার স্থানাঙ্ক হলো x', y', z' (চিত্র ৮.৫ক)। x', y', z', t' এবং x, y, z', ' এর মধ্যে সম্পর্ক হলো-
x' = x - vt... (8.3)
y' = y… (8.4)
t=t'... (8.5)
এবং আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে
t=t'... (8.6)
(8.3) থেকে ( 8.6) পর্যন্ত সমীকরণগুলো গ্যালিলীর রূপান্তর নামে পরিচিত। এখন এই সমীকরণগুলোকে সময়ের সাপেক্ষে অন্তরীকরণ করে S এবং S' কাঠামোর জন্য বেগের উপাংশগুলো পাওয়া যায়,
... (8.9)
বিপরীত গ্যালিলীয় রূপান্তর: আমরা যদি S' কাঠামোর পরিমাপকে S কাঠামোর পরিমাপ রূপান্তরিত করতে চাই তাহলে v এর স্থলে – v বসাতে হবে এবং x', y', z', t' এবং x, y, z, t কে পরস্পর বিনিময় করতে হবে। এভাবে যে রূপান্তর পাওয়া যায় তা হলো বিপরীত গ্যালিলীয় রূপান্তর। সুতরাং
x = x' ... (8.10)
y=y'... (8.11)
z = z'… (8.12)
t=t' … (8.13)
গ্যালিলীয় রূপান্তর এবং বেগ রূপান্তর উভয়েই আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের স্বীকার্য দুটোকে লঙ্ঘন করে।
(১) প্রথম স্বীকার্য অনুসারে S এবং S' কাঠামোতে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলোকে একই প্রকার সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করা উচিত । কিন্তু তড়িৎবিজ্ঞান ও চৌম্বকত্বের বেলায় এক কাঠামোর জন্য প্রযোজ্য সমীকরণগুলো অন্য কাঠামোর জন্য লিখতে গেলে তা পৃথক আকারের হয় যা প্রথম স্বীকার্যের লঙ্ঘন ।
(২) দ্বিতীয় স্বীকার্য অনুসারে আলোর দ্রুতি c, S এবং S' এই উভয় কাঠামোতে একই হবে। S কাঠামোতে X অক্ষের দিকে পরিমাপ করে আলোর দ্রুতি আমরা যদি পাই, S´ কাঠামোতে (8.7) নং সমীকরণ অনুসারে এর মান হবে c' = c' - v অর্থাৎ আলোর দ্রুতি পর্যবেক্ষকের দ্রুতির উপর নির্ভরশীল। এটি দ্বিতীয় স্বীকার্যের লঙ্ঘন ।
সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে যদি সন্তোষজনকভাবে ব্যাখ্যা করতে হয় তবে অন্য একটি রূপান্তর খুঁজে বের করতে হবে।
পরীক্ষার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত আইনস্টাইনের দ্বিতীয় স্বীকার্য অনুসারে আলোর দ্রুতি পর্যবেক্ষকের ওপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু গ্যালিলীয় রূপান্তর অনুসারে আলোর দ্রুতি পর্যবেক্ষকের গতির ওপর নির্ভরশীল। আইনস্টাইন গ্যালিলীয় রূপান্তর এবং দ্বিতীয় স্বীকার্যের মধ্যে অসঙ্গতি খুঁজে পান। কিন্তু পরীক্ষালব্ধ সত্য বলে তিনি দ্বিতীয় স্বীকার্যকে পরিত্যাগ করতে পারলেন না। সুতরাং চিরায়ত বলবিজ্ঞানে গ্যালিলীয় রূপান্তর আপাত সাফল্য অর্জন করলেও এবং সাধারণ অভিজ্ঞতার কাছে এর অবদান থাকলেও আইনস্টাইনকে স্বীকার্য দুটির সাথে মিল আছে এমন একটি রূপান্তর খুঁজতে হয় যা গ্যালিলীয় রূপান্তরের স্থান দখল করতে পারে এবং যথোপযুক্ত শর্তাবলির মাধ্যমে গ্যালিলীয় রূপান্তরে পৌঁছতে পারে।
১৯৩০ সালে এইচ. এ. লরেন্টজ (H. A. Lorentz)-এর তাড়িতচৌম্বক তত্ত্বের মধ্য দিয়ে এ সমীকরণগুলো জন্মলাভ করেছিল বলে এদেরকে লরেন্টজ রূপান্তর বলা হয়।
লরেন্টজ রূপান্তর সমীকরণগুলো নিচে দেওয়া হলো :
.. (8.14)
y' = y... (8.15)
z' = z.. (8.16)
… (8.17)
আমরা যদি S' কাঠামোর পরিমাপকে S কাঠামোর পরিমাপে রূপান্তরিত করতে চাই তাহলে v এর স্থলে -v বসাতে হবে এবং x', y', z', t' এবং x, y, z, t কে পরস্পর বিনিময় করতে হবে। এভাবে যে রূপান্তর পাওয়া যায় তা হলো বিপরীত লরেন্টজ রূপান্তর।
বিপরীত লরেন্টজ রূপান্তর সমীকরণগুলো হলো
. . (8.18)
y = y'... (8.19)
z = z'.. (8.20)
… (8.21)
লরেন্টজ রূপান্তরের বিশেষত্ব : লরেন্টজ রূপান্তরের দুটি সুস্পষ্ট দিক রয়েছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হলো, সময় এবং অবস্থানের পরিমাপ পর্যবেক্ষকের প্রসঙ্গ কাঠামোর উপর নির্ভরশীল এবং একটি কাঠামোতে পৃথক স্থানে দুটি ঘটনা যুগপৎ ঘটলেও অন্য কাঠামোতে যুগপৎ নাও ঘটতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো, S এবং S' এর আপেক্ষিক বেগ v আলোর বেগের তুলনায় অত্যন্ত কম হলে লরেন্টজ রূপান্তর গ্যালিলীয় রূপান্তরে পরিবর্তিত হয়ে যায় ।
যখন v<< c ; তখন
এবং লরেন্টজ রূপান্তরের সমীকরণগুলো দাড়ায়-
y' = yy
z' = zz
t' = t
যা আসলে প্যালিলীয় রূপান্তর সমীকরণ।
যখন বস্তুর দ্রুতি আলোর দ্রুতির কাছাকাছি তখনই লরেন্টজ রূপান্তর প্রয়োগ করা হয়।
কাল বা সময়ের পরিমাপ পর্যবেক্ষক ও যা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে তার আপেক্ষিক গতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। গতিশীল ঘড়ি নিশ্চল ঘড়ির চেয়ে ধীরে চলে। অর্থাৎ যে ঘড়ি কোনো পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে গতিশীল সেই ঘড়িটি যদি গতিশীল না হয়ে নিশ্চল থাকত তাহলে যে সময় দিত তার চেয়ে গতিশীল অবস্থায় কম সময় দেবে।
ধরা যাক, মহাশূন্যযানে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তি মহাশূন্যযানে ঘটা দুটি ঘটনার মধ্যবর্তী সময় বা কাল ব্যবধান to নির্ণয় করলেন t । ভূ-পৃষ্ঠ থেকে কোনো ব্যক্তি ঐ সময় ব্যবধান নির্ণয় করলেন। দেখা যাবে যে, সময় ব্যবধান t, সময় ব্যবধান to এর চেয়ে দীর্ঘতর। সময় ব্যবধান to কে (যা পর্যবেক্ষকের প্রসঙ্গ কাঠামোতে একই স্থানে ঘটা দুটি ঘটনার সময় ব্যবধান) ঘটনা দুটি ঘটার মধ্যবর্তী প্রকৃতকাল বা প্রকৃত সময় (Proper time) বলা হয়। যে ব্যক্তি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সময় পরিমাপ করছেন তার কাছে সময় ব্যবধানের শুরু ও শেষ দুটি পৃথক স্থানে ঘটছে ফলে সময় ব্যবধান প্রকৃত সময়ের চেয়ে দীর্ঘায়িত বলে দেখা দিচ্ছে। এই প্রভাবকে বলা হয় কাল দীর্ঘায়ন (time dilation ) ।
সময় to ও t এর মধ্যে সম্পর্ক হলো
কোনো গতিশীল বস্তুর জন্য রাশিটি সব সময় 1 এর চেয়ে ছোট, তাই t সবসময়ই to এর চেয়ে বড়। সমীকরণ (8.22) কালদীর্ঘায়ন প্রকাশকারী সমীকরণ।
সুতরাং ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থানকারী কোনো পর্যবেক্ষক এটা দেখতে পাবেন যে চলন্ত মহাশূন্যযানে অবস্থিত কোনো ঘড়ি ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত নিশ্চল ঘড়ির চেয়ে ধীর গতিতে চলবে। আপেক্ষিক গতি v এর মান যত বেশি হবে গতিশীল ঘড়ি তত ধীরে চলবে এবং কাল দীর্ঘায়ন তত বেশি হবে। to কে বলা হয় যথোপযুক্ত বা প্রকৃত সময় (proper time)।
নিশ্চল কাঠামোতে অবস্থিত একটি ঘড়ি গতিশীল কাঠামোতে সংঘটিত ঘটনাগুলোর মধ্যবর্তী কাল ব্যবধান গতিশীল কাঠামোতে অবস্থিত ঘড়ির চেয়ে অধিক নির্ণয় করবে। অর্থাৎ গতিশীল কাঠামোতে সংঘটিত ঘটনাগুলোর বেলায় একটি নিশ্চল কাঠামোতে অবস্থিত ঘড়ি গতিশীল কাঠামোতে অবস্থিত ঘড়ির চেয়ে অধিক কাল ব্যবধান নির্ণয় করবে। একটি উদাহরণ বিবেচনা করা যাক। মনে করা যাক, গতিশীল কাঠামোতে একটি ঘটনা সংঘটিত হলো। গতিশীল কাঠামোর একজন পর্যবেক্ষক এর কাল ব্যবধান তথা ঘটনা সংঘটনের সময় হিসেব করলেন। স্থির কাঠামোতে অবস্থিত একজন পর্যবেক্ষক এই কাল ব্যবধান হিসেব করলেন to। ধরা যাক, কাঠামো দুটির আপেক্ষিক বেগ v = 0.98 c, যেখানে c আলোর বেগ ।
সুতরাং
সুতরাং গতিশীল কাঠামোর ঘড়ি যে কাল ব্যবধান to পরিমাপ করে, নিশ্চল কাঠামোতে অবস্থিত ঘড়ি উক্ত কাল ব্যবধান পরিমাপ করে Sto, অর্থাৎ গতিশীল কাঠামোর একজন পর্যবেক্ষক ঐ কাঠামোতে কোনো কাজের জন্য যে সময় ব্যয় করেন, স্থির কাঠামোর কোনো পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হবে ঐ পর্যবেক্ষক ঐ কাজের জন্য পাঁচগুণ বেশি সময় ব্যয় করেছেন। এটিই কাল দীর্ঘায়ন। সুতরাং গতিশীল কাঠামোর ঘড়ি যখন একটি 'টিক' দেয় নিশ্চল কাঠামোর ঘড়ি তখন পাঁচটি 'টিক' দেয়। এর অর্থ গতিশীল কাঠামোর ঘড়িতে এক সেকেন্ড অতিবাহিত হলে নিশ্চল কাঠামোর ঘড়িতে পাঁচ সেকেন্ড অতিবাহিত হবে। অর্থাৎ নিশ্চল কাঠামোর ঘড়িটি গতিশীল কাঠামোর ঘড়ি অপেক্ষা পাঁচগুণ দ্রুত চলে।
সময় পরিমাপের মতো আপেক্ষিক গতি দ্বারা দৈর্ঘ্য পরিমাপও প্রভাবিত হয়।
চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের মতে বস্তুর সাপেক্ষে পর্যবেক্ষকের বেগ যাই হোক না কেন সকল পর্যবেক্ষকের নিকট বন্ধুর দৈর্ঘ্য সমান বা অভিন্ন থাকে। কিন্তু আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে গতির সাথে বস্তুর দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন ঘটে।
যদি পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে গতিশীল কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য হয় L এবং যদি ঐ পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে নিশ্চল অবস্থায় একই বস্তুর দৈর্ঘ্য হয় Lo, তাহলে L সব সময়ই Lo এর চেয়ে ছোট হবে। অর্থাৎ কোনো বস্তুর গতিশীল অবস্থায় দৈর্ঘ্য ঐ বস্তুর নিশ্চল অবস্থায় দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট। এখানে Lo কে বলা হয় যথোপযুক্ত বা প্রকৃত দৈর্ঘ্য (Proper length).
দৈর্ঘ্য সংকোচনের সমীকরণটি হলো,
L = Lo
এখানে, L = পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে গতিশীল অবস্থায় বস্তুর দৈর্ঘ্য
Lo =পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে গতিশীল অবস্থায় বস্তুর দৈর্ঘ্য
v = আপেক্ষিক দ্রুতি
c = আলোর দ্রুতি
এখানে সব সময়ই 1 এর চেয়ে ছোট। সুতরাং L সব সময় Lo এর চেয়ে ছোট।
সুতরাং কোনো দণ্ডের গতিশীল অবস্থার দৈর্ঘ্য দণ্ডটির নিশ্চল অবস্থার দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট হবে।
যেহেতু (8.25 বা 8.28 ) নং সমীকরণে S এবং S' কাঠামো দুটির আপেক্ষিক বেগ v এর বর্গ দ্বারা প্রকাশিত হয়েছে, সুতরাং যে কোনো কাঠামোকেই S এবং S' বলি না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। উক্ত সমীকরণ থেকে আরো বোঝা যায় যে, ভূটি যে কাঠামোতে নিশ্চল সে কাঠামোতে তার দৈর্ঘ্য সর্বাধিক এবং যে কাঠামোতে সে গতিশীল সে কাঠামোতে তার দৈর্ঘ্য কম ।
সাধারণ বেগের বেলায় আপেক্ষিক তত্ত্বীয় দৈর্ঘ্য সংকোচন অত্যন্ত কম এবং তা উপেক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু বন্ধুর বেগ যখন আলোর কাছাকাছি তখন এই সংকোচন অনেক বেশি হয়।
নিউটনীয় বলবিজ্ঞান থেকে আমরা জানি যে, বস্তুর ভর একটি ধ্রুবক। স্থান, কাল ও বেগের পরিবর্তনের ওপর এটি নির্ভরশীল নয় বা এটি পরিবর্তিতও হয় না। কিন্তু আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মতে বস্তুর ভর কোনো ধ্রুবক নয়, আপেক্ষিক। বস্তুর বেগের সাথে ভরের একটি সম্পর্ক আছে এবং বস্তুর চলমান বা গতিশীল ভর ও নিশ্চল ভর সমান নয়। বস্তুর বেগ বৃদ্ধির সাথে সাথে ভর বৃদ্ধি পায়। পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে কোনো বস্তু যদি v দ্রুতিতে গতিশীল হয়।
তাহলে এর গতিশীল ভর পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে এর নিশ্চল ভরের চেয়ে গুণ বেশি হবে।
মহাশূন্যে চলমান কোনো মহাশূন্যযানের ভর পৃথিবী থেকে মাপা হলে এর ভর পৃথিবীতে অবস্থিত এর নিশ্চল ভরের পরিমাপের চেয়ে বেশি হবে, কিন্তু একে দেখতে ছোট দেখাবে। মহাশূন্যবানের কোনো যাত্রী যদি পৃথিবীর নিশ্চল অবস্থার মহাশূন্যযানের দৈর্ঘ্য ও ভর মাপেন তাহলে তিনি গতিশীল মহাশূন্যযানের চেয়ে নিশ্চল মহাশূন্য যানের দৈর্ঘ্য ছোট কিন্তু ডর বেশি মাপবেন (রকেটের যে দ্রুতি রয়েছে সে দ্রুতিতে এই প্রভাব অবশ্য পর্যবেক্ষণযোগ্য নয়)।
কোনো বস্তুর নিশ্চল অবস্থায় ভর যদি mo, হয় এবং এর চলমান অবস্থায় ভর যদি m হয় এবং বস্তুটি যদি v দ্রুতিতে গতিশীল হয় তাহলে mo ও m এর সম্পর্ককে নিচের সমীকরণ দিয়ে লেখা যায়,
... (8.29)
বস্তুর দ্রুতি আলোর দ্রুতির যত কাছাকাছি পৌঁছাতে থাকে এর ভর ভত তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বস্তুর দ্রুতি যখন আলোর এক-দশমাংশ অর্থাৎ, 0.1 c তখন এর ভর বৃদ্ধি মাত্র শতকরা 0.5, দ্রুতি যখন আলোর দ্রুতির নয় দশমাংশ অর্থাৎ 0.9 c তখন এর ভর বৃদ্ধি শতকরা 100 ভাগেরও বেশি। পারমাণবিক কণিকা ইলেক্ট্ৰন, প্রোটন, নিউট্রন, মেসন ইত্যাদির দ্রুতি এত বেশি যে এদের গতির বেলায় আপেক্ষিকতা প্রভাব বিবেচনায় আনতে হয় এবং এদের গতির ক্ষেত্রে পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্রগুলো খাটে না।
আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের সাহায্যে একটি বিখ্যাত সম্পর্ক বের করেন। এটি হলো ভর ও শক্তির সম্পর্ক। ভরকে শক্তিতে রূপান্তরের সম্পর্ক নিম্নোক্তভাবে লেখা যায়,
E = mc2
যেখানে, E = মোট শক্তি
m= বস্তুর ভর এবং
c = আলোর দ্রুতি
গতিশীল অবস্থায় বস্তুর ভর বৃদ্ধি পায় এই তথ্য ব্যবহার করে কোনো বস্তুর। গতিশক্তি নির্ণয় করলে দেখা যায় যে, ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করলে প্রচুর শক্তি পাওয়া সম্ভব। এই বিষয়ে | একটি প্রতিবেদন তৈরি কর।
সংকেত : আমরা জানি যে, কোনো বস্তুকে নিশ্চল অবস্থা থেকে গতিশীল অবস্থায় আনতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয় তাকে বস্তুর গতিশক্তি বলে। অর্থাৎ
বস্তুর গতিশক্তি = গতিশীল হতে বস্তু দ্বারা সম্পাদিত কাজ।
ধরা যাক, বস্তুটিকে গতিশীল করতে F বল প্রয়োগ করা হলো এবং বস্তুটি বলের দিকে ds পরিমাণ দূরত্ব গেল।
সুতরাং গতিশক্তি = Fds
বস্তুটি মোট দূরত্ব S হলে
মোট গতিশক্তি,
আমরা জানি যে,
ভরের আপেক্ষিকতা থেকে আমরা জানি যে,
এখন F ও ds এর মান বসিয়ে,
এই সমীকরণটি বর্গ করে পাওয়া যায়,
বা, (1 - v2/c2)m2 = m2o
বা, m²c2 - m²y2 = m2oc2
এই সমীকরণকে অন্তরীকরণ করে পাওয়া যায় যে,
2mc2dm - (2mv2dm + 2vm2dv) = 0
উপরোক্ত সমীকরণকে 2m দ্বারা ভাগ করে পাওয়া যায়,
c2dm-v2dm = mvdv
বা, mvdv + v2dm = c2dm
এই মান ( 8.38) সমীকরণে বসালে,
এখানে mo হলো নিশ্চল ভর।
কিন্তু মোট শক্তি, E = T + moc2 = গতিশক্তি + নিশ্চল শক্তি
:- E = mc2
এই সমীকরণটি আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের অন্যতম ফসল যা হলো ভর শক্তির একটি রূপ। আবার শক্তির ও ভর রয়েছে বা শক্তিও ভরের একটি রূপ। ভরকে শক্তিতে রূপান্তর তেজস্ক্রিয় পদার্থের ক্ষমতার উৎস এবং নিউক্লিয় ক্ষমতা (বিদ্যুৎ) উৎপাদনের ভিত্তি।
আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে দুটি বল সবসময়ই অনুভব করে থাকি। একটি হচ্ছে অভিকর্ষ বল—ভূপৃষ্ঠে বা তার নিকটে সকল বস্তুর ওপর পৃথিবীর আকর্ষণ বল। অপরটি হচ্ছে ঘর্ষণ বল— কোনো তলের ওপর দিয়ে অপর তলের চলাচলের সময় যে বল উৎপন্ন হয়। এ ছাড়াও আমরা অন্য যে সকল বলের সাক্ষাৎ পাই সেগুলো হলো কোনো বিকৃত স্প্রিং-এর পুনরানয়ন বল, দুটি আহিত বস্তুর মধ্যকার স্থির তড়িৎ বল এবং একটি চুম্বক ও লোহার টুকরার মধ্যকার চৌম্বক বল। পরমাণু ও নিউক্লিয়াসের সূক্ষ্ম জগতেও বল ক্রিয়া করে। যেমন, পরমাণুর অভ্যন্তরে পারমাণবিক বলসমূহ পরমাণুর উপাদানসমূহকে একত্রে রাখে। নিউক্লিয় বল নিউক্লিয়াসের বিভিন্ন অংশে ক্রিয়া করে এই অংশগুলোকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। এ সকল বল জটিল দেখালেও প্রকৃতিতে কেবল চারটি মৌলিক বল এবং তাদের মধ্যকার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বা মিথস্ক্রিয়া (interaction) বিদ্যমান।
মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যকার পারস্পরিক আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বল বলে। কোনো বস্তুর ওজন হচ্ছে মহাকর্ষ বলের ফলশ্রুতি। যদিও স্থূল বস্তুগুলোর মধ্যকার মহাকর্ষ বল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু চারটি মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ বল হচ্ছে দুর্বলতম বল। অবশ্য এই কথাটি প্রযোজ্য হয় মৌলিক কণাগুলোর পারস্পরিক বল বিবেচনা করে তাদের আপেক্ষিক সবলতার বিচারে। যেমন, কোনো হাইড্রোজেন পরমাণুতে ইলেকট্রন ও প্রোটনের মধ্যকার মহাকর্ষ বল হচ্ছে 3-6 x 10-47 N; অপরপক্ষে এই কণা দুটির মধ্যকার স্থির তড়িৎ বল হচ্ছে 8 2 × 10-8 N । এখানে আমরা দেখি যে, স্থির তড়িৎ বলের তুলনায় মহাকর্ষ বল তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
দুটি আহিত কণা তাদের আধানের কারণে একে অপরের ওপর যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল প্রয়োগ করে তাকে তাড়িতচৌম্বক বল বলে। তড়িৎ বল এবং চৌম্বক বল ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। যখন দুটি আহিত কণা স্থির থাকে তখন তাদের ওপর কেবল তড়িৎ বল ক্রিয়া করে। যখন আহিত কণাগুলো গতিশীল থাকে তখনকার একটি অতিরিক্ত তড়িৎ বল হচ্ছে চৌম্বক বল। যদিও দুটি আহিত মৌলিক কণার মধ্যকার তড়িৎ বল মহাকর্ষ বলের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী, তবুও সবলতার বিচারে তড়িৎ বল হচ্ছে মাঝারি ধরনের। লক্ষণীয় যে, আমাদের এই স্কুল জগতের যাবতীয় বলসমূহ (মহাকর্ষ বল ব্যতীত) তড়িৎ বলেরই বহিঃপ্রকাশ। ঘর্ষণ বল, স্পর্শ বল, স্প্রিং বা অন্যান্য বিকৃত বস্তুর মধ্যকার বল আহিত কণাগুলোর তড়িৎ বলেরই ফলশ্রুতি
পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউক্লিয় উপাদান তথা নিউক্লিয়নগুলোকে একত্রে আবদ্ধ রাখে যে শক্তিশালী বল তাকে সবল নিউক্লিয় বল বলে। নিউক্লিয়াসের স্থায়িত্বের জন্য অবদান রাখে যে বল তা হলো সবল নিউক্লিয় বল। এই বলই নিউক্লিয়নগুলোকে একত্রে রাখার জন্য আঠার মতো কাজ করে। সবগুলো মৌলিক বলের মধ্যে এই বলই সবচেয়ে শক্তিশালী। এর পাল্লা 10-15 m. যা একটি নিউক্লিয়াসের ব্যাসার্ধের সমান। দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে সবল নিউক্লিয় বল হ্রাস পায় এবং 10-14m এর বেশি দূরত্বে এ বল উপেক্ষণীয় ।
এই বল কয়েকটি নিউক্লিয় বিক্রিয়ার জন্য দায়ী। এই বল অনেক নিউক্লিয়াসে অস্থিতিশীলতার উদ্ভব ঘটায়। অধিকাংশ তেজস্ক্রিয় ভাঙন বিক্রিয়াগুলো দুর্বল নিউক্লিয় বলের কারণে ঘটে থাকে।
মৌলিক বলগুলোর তুলনা করা যাক। প্রত্যেকটি বলের পাল্লা তথা যে দূরত্ব পর্যন্ত বলগুলো ক্রিয়া করে তা বিবেচনা করা যাক। মহাকর্ষ বল এবং তাড়িতচৌম্বক বল হচ্ছে বিপরীতবর্গীয় বল। দূরত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে এই বলগুলোর মান হ্রাস পায়, কিন্তু কখনো শূন্য হয় না। এই দুই বলের পাল্লা হচ্ছে অসীম। সবল নিউক্লিয় বলের পাল্লা খুবই কম; 10-15m-এর বেশি দূরত্বে এই বল অনুভূত হয় না। দুর্বল নিউক্লিয় বলের পাল্লা আরো কম, 10-16m এরও কম।
বলের পাল্লার মধ্যে অবস্থিত মৌলিক কণাগুলোর মধ্যকার বলের মান দ্বারা একটি বলের আপেক্ষিক সফলতা বিচার করা হয়। সবলতার একটি স্কেলে যদি মহাকর্ষ বলের সূচক 1 হয়, তাহলে দুর্বল নিউক্লিয় বলের সূচক 1030, তাড়িতচৌম্বক বলের সূচক 1039 এবং সবল নিউক্লিয় বলের সূচক 1041 হয় ।
মহাকাশ ভ্রমণে আপেক্ষিকতা তত্ত্বের যে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক তা হলো কাল দীর্ঘায়ন। আমরা জানি যে, পৃথিবী থেকে কোনো ব্যক্তি মহাকাশ ভ্রমণে গেলে পৃথিবীর কোনো পর্যবেক্ষকের নিকট মহাকাশচারীর ঘড়ি, পৃথিবীতে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তির অভিন্ন ঘড়ির চেয়ে ধীরে চলে । অর্থাৎ কম সময় দেয়। মহাকাশ ভ্রমণে এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হয় । এ প্রসঙ্গে আমরা যমজ কূটাভাসের (Twin paradox) কথা বলতে পারি। কূটাভাস হলো এমন ঘটনা যা আপাত দৃষ্টিতে সত্য মনে না হলেও আসলে সত্য।
যমজ কূটাভাস : কাল দীর্ঘায়নের একটি মজার ফলাফল বা পরিণতি হলো যমজ কুটাভাস। ২০ বছর বয়সী দুই যমজ ভাই সাদিক ও ইকবালকে নিয়ে একটি নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ বিবেচনা করা যাক। সাদিক ভ্রমণবিলাসী সে পৃথিবী | থেকে ৩০ আলোক বর্ষ দূরে একটি গ্রহে যেতে পৃথিবী থেকে রওনা হলো। তার মহাশূন্য যান প্রায় আলোর সমান দ্রুতিতে যেতে সক্ষম। গ্রহে পৌঁছার পর সাদিকের মন বাড়ির জন্য আনচান করতে লাগল। তাই সে একই দ্রুতিতে (আলোর কাছাকাছি দ্রুতিতে) পৃথিবীতে ফিরে এলো। পৃথিবীতে ফিরে সে দেখে অবাক হলো যে, পৃথিবীর অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। সাদিকের যমজ ভাই ইকবালের বয়স প্রায় ৮০ বছর। আর সাদিকের বয়স তার চেয়ে কম হয়েছে প্রায় ১০ বছর। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে কোন যমজ ভাই (সাদিক না ইকবাল) একে অপরের তুলনায় আলোর কাছাকাছি দ্রুতিতে ভ্রমণ করেছে, সুতরাং কার বয়স বাড়েনি। এখানেই রয়েছে কূটাভাস (paradox) | ইকবালের প্রসঙ্গ কাঠামোর সাপেক্ষে ইকবাল নিশ্চল কিন্তু সাদিক অত্যন্ত বেশি বেগ নিয়ে ভ্রমণ করেছে। সাদিকের মতে, যদিও ইকবাল পৃথিবীতে সাদিকের সাপেক্ষে দূরে চলে যাচ্ছে এবং পরে ফিরে আসছে। এটাই হলো অসঙ্গতি যে আমাদের উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী বা ধারণায় কোনো যমজ ভাই প্রকৃতপক্ষে বেশি বয়স্ক । |
---|
এই কূটাভাসের সমাধানের জন্য এটা মনে রাখতে হবে যে আমরা ভ্রমণকে যতোটা প্রতিসম মনে করছি আসলে তা নয়। মহাশূন্যচারী সাদিক তার ভ্রমণকালে ভিন্ন গ্রহে গমন ও পৃথিবীতে ফিরে আসতে একরাশ ত্বরণ ও মন্দনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসেছে। সুতরাং সে তার ভ্রমণকালের একটি বৃহৎ অংশে জড় প্রসঙ্গ কাঠমোতে ছিল না। সুতরাং এই প্রসঙ্গ কাঠামোতে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ভিত্তিতে করা ভবিষ্যদ্বাণী খাটে না। অপরপক্ষে ইকবাল সকল সময়েই তার জড় প্রসঙ্গ কাঠামোতে রয়েছে, সুতরাং তার বেলায় আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ভিত্তিতে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। সুতরাং মহাশূন্যচারী সাদিককে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর অল্প বয়সী মনে হবে। মহাকাশ ভ্রমণের সময় মহাশূন্যচারীকে কাল দীর্ঘায়নের ব্যাপারটি বিবেচনায় রাখতে হবে। কাল দীর্ঘায়নের কারণে অতিদ্রুতগামী মহাশূন্য যানের আরোহী তার বয়স খুব কম থেকে যাবে। এর কারণ হলো মহাশূন্যযানের ঘড়ি, পৃথিবীতে থাকা পর্যবেক্ষকের ঘড়ির চেয়ে ধীরে চলবে । মূলত কম সময় অতিবাহিত হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, এক বছর ভ্রমণকাল পৃথিবীর ১০ বছরের সমান হতে পারে । পৃথিবীর ঘড়ির সময় অনুসারে কোনো মহাশূন্যযানে যাত্রী কোটি কোটি বছর পরেও পৃথিবীতে ফিরতে পারে। বাস্তব সমস্যার উপর ভিত্তি করে বর্তমান মহাশূন্য উড্ডয়ন প্রযুক্তিতে একটা তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ মহাশূন্য যানের দ্রুতি আলোর কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে এর প্রচলনের ( propulsion) জন্য যে শক্তির প্রয়োজন তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
এছাড়া মহাশূন্য ভ্রমণে অত্যধিক দ্রুতিতে (আলোর কাছাকাছি দ্রুতিতে) স্থান সংকোচনের ব্যাপারটি মাথায় রাখতে হবে। মহাশূন্যচারীর দিকে অগ্রসর হওয়া কোনো যানকে স্থান সংকোচনের কারণে ছোট মনে হবে, অপর মহাশূন্যচারীও তাই দেখবেন। এছাড়া কোনো মহাশূন্যযান পৃথিবীতে ফেরার সময় পৃথিবীর পর্যবেক্ষক একে সে উচ্চতায় দেখবেন, মহাশূন্যচারী তার চেয়ে কম উচ্চতায় দেখবেন।
যে বস্তু এর ওপর আপতিত সকল বিকিরণ শোষণ করে তাকে কালো বস্তু বলে। তাপগতি বিজ্ঞানের কালোবস্তুকে নিম্নোক্তভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
অন্য কথায়, যে বস্তু সকল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকীর্ণ তাপ শোষণ করে তাকে আদর্শ কালো বস্তু বলে। আদর্শ কালো বস্তুকে উত্তপ্ত করলে এটি সকল তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বিকিরণ নিঃসরণ করে। তাই একে কালো বস্তু বিকিরণও বলা হয়। অর্থাৎ কোনো আদর্শ কালো বস্তুর ওপর আপতিত সকল বিকিরণ শোষিত হয় আবার ঐ কালো বস্তুকে উত্তপ্ত করলে বস্তুটি সকল বিকিরণ নিঃসরণ করে। তাই বলা হয়, আদর্শ কালো বস্তু উত্তম শোষক ও উত্তম বিকিরক।
আমরা জানি যে, কোনো বস্তুতে যদি বিকিরণ আপতিত হয় তাহলে ঐ বিকিরণের কিছু অংশ বস্তুর দ্বারা শোষিত হয় এবং কিছু অংশ প্রতিফলিত হয় এবং বস্তুটি স্বচ্ছ হলে কিছু অংশ সঞ্চালিত হয়। a দিয়ে যদি বস্তুটিতে আপতিত বিকিরণের শোষিত অংশ । দিয়ে প্রতিফলিত অংশ এবং দিয়ে সঞ্চালিত অংশ বোঝায় তাহলে সাধারণ বস্তুর বেলায় a + r + t = 1 । কিন্তু আদর্শ কালোবস্তুর বেলায় কোনো বিকিরণ প্রতিফলিত ও সঞ্চালিত হয় না। এক্ষেত্রে r = 0 এবং t= 0, সুতরাং a = 1 কালোবস্তু শোষণ ক্ষমতা ৷ অর্থাৎ কালোবস্তু আপতিত বিকিরণের সম্পূর্ণটাই শোষণ করে। এটিই কালো ও বাস্তব বিকিরণের প্রধান পার্থক্য ।
তাপ বিকিরণ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, এই বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বণ্টন বর্ণালির অবলোহিত অঞ্চল থেকে শুরু করে দৃশ্যমান অঞ্চল ও অতিবেগুনি অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত।
চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের মতে, বস্তুর পৃষ্ঠের নিকটবর্তী আহিত কণা ত্বরিত হলে তাপ বিকিরণ উৎপন্ন হয় এবং ছোট অ্যানটেনার মতো বিকিরণ নিঃসরণ করে। তাপীয়ভাবে উত্তেজিত আহিত কণার ত্বরণের বিন্যাস এমন হয় যে, বস্তু দ্বারা বিকিরণের নিরবচ্ছিন্ন বর্ণালি নিঃসৃত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, তাপ বিকিরণের চিরায়ত তত্ত্ব অপর্যাপ্ত কারণ, কালো বস্তু থেকে নিঃসৃত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বন্টনের ব্যাখ্যা দিতে এটি সক্ষম হয় না। কালোবস্তুর তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে, কালোবস্তু কর্তৃক নিঃসৃত মোটশক্তি বৃদ্ধি পায়। পরীক্ষালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, এই শক্তি বিকিরণের হার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের উপর নির্ভরশীল। এ সময়ে ভীন বলেন কালো বস্তুর শক্তি বণ্টন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পঞ্চম ঘাতের ব্যস্তানুপাতিক এবং মর্মে তিনি একটি সূত্র প্রদান করেন।
ভীনের সূত্র ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বেলায় খাটে, কিন্তু দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বেলায় খাটে না। প্রাথমিকভাবে তরঙ্গ তত্ত্ব দ্বারা এর ব্যাখ্যা সম্ভব হয় না। পরে রেলি-জিন্স (Rayleigh Jeans) কোনো বস্তুর শক্তি বণ্টনের সম্পর্কে বলেন যে, তা' তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্থ ঘাতের ব্যস্তানুপাতিক এবং সেই মর্মে তাঁরা একটি সূত্র প্রদান করেন। দীর্ঘ তরঙ্গদৈর্ঘ্যে রেলি- জিসের সূত্র পরীক্ষালব্ধ ফলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু ক্ষুদ্রতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যে এটি পরীক্ষালব্ধ ফলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এই প্রেক্ষিতে ১৯০০ সালে ম্যাক্সপ্লাঙ্ক বলেন যে, বিকিরণ নিঃসরণকারী স্পন্দনশীল অণু শক্তির যে একক E নিঃসরণ করে তা ছিন্নায়িত এবং E = hf
এখানে f হলো অণুর কম্পনের কম্পাঙ্ক এবং h প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক, যার মান 6.63 x 10-34 Js। অণুর শক্তিকে বলা হয় কোয়ান্টায়িত এবং অনুমোদিত শক্তি অবস্থাকে বলা হয় কোয়ান্টাম অবস্থা।
প্ল্যাঙ্ক শক্তি বণ্টনের যে সূত্রটি প্রদান করেন সেটি হচ্ছে
এখানে, h = প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক = 6.63 x 10-34Js, c = আলোর দ্রুতি = বিকিরিত শক্তির তরঙ্গদৈর্ঘ্য, k = বোলজম্যান ধ্রুবক এবং T = কেলভিন তাপমাত্রা। প্লাঙ্কের এই সমীকরণ থেকে প্রাপ্তমান পরীক্ষালব্ধ মানের সাথে মিলে যায়।
১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক সর্বপ্রথম এই কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রদান করেন এবং আইনস্টাইন তা সম্প্রসারিত করেন। প্ল্যাঙ্ক বললেন, কোনো বস্তু থেকে শক্তি নিরবচ্ছিন্নভাবে নিঃসৃত হয় না। শক্তি বা বিকিরণ ছিন্নায়িত অর্থাৎ শক্তি গুচ্ছ গুচ্ছ আকারে প্যাকেট বা কোয়ান্টাম হিসেবে নিঃসৃত হয়। আলো তথা যে কোনো বিকিরণ অসংখ্য বিকিরণ কোয়ান্টার সমষ্টি। প্ল্যাঙ্ক মনে করতেন কেবলমাত্র নিঃসরণ বা শোষণের সময় বিকিরণ বা শক্তি ছিন্নায়িত হয় অর্থাৎ কণারূপে নির্গত বা শোষিত হয় কিন্তু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তরঙ্গ আকারে নিরবচ্ছিন্নভাবে সঞ্চালিত হয়।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে আইনস্টাইন প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করে বলেন, শুধু নিঃসরণ বা শোষণের সময়ই শক্তি ছিন্নায়িত হয় না অর্থাৎ কণারূপে নির্গত বা শোষিত হয় না, শক্তি যখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয় তখনও তা কণারূপে বিরাজ করে এবং ঐ কণাগুলোই আলোর বেগে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছিন্নায়িতভাবে শক্তি সঞ্চালিত করে। এই কণাগুলোকে বলা হয় ফোটন।
১৮৯৫ সালে রন্টজেন পর্যবেক্ষণ করেন যে, দ্রুতগতি সম্পন্ন ইলেকট্রন কোনো ধাতুতে আঘাত করলে তা থেকে উচ্চ ভেদন ক্ষমতাসম্পন্ন এক প্রকার বিকিরণ উৎপন্ন হয়। এর প্রকৃতি তখন বিজ্ঞানীদের কাছে ছিল অজানা। এ বিকিরণকে বলা হয় এক্স-রে।
এক্স-রে দু প্রকার;
এক্স-রে যন্ত্রে কম বিভব পার্থক্য প্রয়োগ করে যে এক্স-রে পাওয়া যায় তাকে কোমল এক্স-রে বলে। এক্স-রে যন্ত্রে প্রযুক্ত বিভব পার্থক্য বেশি হলে যে এক্স-রে উৎপাদিত হয় তাকে কঠিন এক্স-রে বলে ।
বিজ্ঞানী রন্টজেন তড়িৎক্ষরণ নলে 10-3 mm পারদস্তম্ভ চাপে বায়ুর মধ্যে তড়িৎক্ষরণের পরীক্ষা করতে গিয়ে লক্ষ করেন যে, নল থেকে কিছু দূরে অবস্থিত বেরিয়াম প্লাটিনোসায়ানাইড দ্বারা আবৃত পর্দায় প্রতিপ্রভার সৃষ্টি হচ্ছে। পরে তিনি আবিষ্কার করেন যে, তড়িৎক্ষরণ নল থেকে ক্যাথোড রশ্মি যখন নলের দেয়ালে পড়ে তখন এই রশ্মির উৎপত্তি হয়। তিনি এই রশ্মির নাম রাখেন এক্স-রে।
৮.৮ চিত্রে একটি 'এক্স-রে টিউব' এর প্রয়োজনীয় অংশসমূহ দেখানো হয়েছে। ফিলামেন্ট F এর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ প্রবাহ ক্যাথোড C-কে উত্তপ্ত করে। ফলে ইলেকট্রনগুলো ক্যাথোড থেকে তাদের বন্ধন মুক্তির যথেষ্ট গতিশক্তি পায় এবং তাপীয় নিঃসরণ প্রক্রিয়ায় ক্যাথোড থেকে মুক্ত হয়ে আসে। তারপর একটি অতি উচ্চ বিভব পার্থক্য V-এর দ্বারা ইলেক্ট্রনগুলো ত্বরিত হয় ও অ্যানোডরূপী লক্ষ্যবস্তু T-তে আঘাত করে। ক্যাথোড থেকে অ্যানোডে যাবার সময় ও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার পূর্বে ইলেক্ট্রনগুলো ৰিপুল পরিমাণে গতিশক্তি অর্জন করে। এ গতিশক্তি T-কে নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করা হয়,
T= eV
এ ক্ষেত্রে e হলো ইলেকট্রনের আধান। ক্যাথোড ত্যাগের সময় ইলেকট্রনের যে গতিশক্তি থাকে তা eV-এর তুলনায় অনেক কম বলে আমরা এখানে তা উপেক্ষা করেছি। ক্যাথোড থেকে আগত ইলেকট্রনগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাতের সময় এদের গতিশক্তির কিছু অংশ এক্স-রে উৎপন্ন করে। এক্স-রে টিউবে ইলেকট্রনের স্রোত নিয়ন্ত্রণ করে এক্স-রের তীব্রতার হ্রাস-বৃদ্ধি এবং ক্যাথোড ও লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে বিভব পার্থক্যের মান নিয়ন্ত্রণ করে প্রয়োজন মত কোমল বা কঠিন যে কোনো ধরনের এক্স-রে উৎপন্ন করা যায় ।
বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে এক্স-রের নিম্নোক্ত ধর্মাবলি আবিষ্কৃত হয়েছে :
(১) এ রশ্মি সরলরেখায় গমন করে।
(২) এটি অত্যধিক ভেদন ক্ষমতাসম্পন্ন।
(৩) এক্স-রে তাড়িতচৌম্বক তরঙ্গ। তড়িৎ ক্ষেত্র বা চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা এটি বিক্ষিপ্ত হয় না।
(৪) এটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব ছোট, প্রায় 10-10m এর কাছাকাছি।
(৫) সাধারণ আলোর ন্যায় এক্স-রের প্রতিফলন, প্রতিসরণ, ব্যতিচার, অপবর্তন ও সমবর্তন হয়ে থাকে।
(৬) ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর এর প্রতিক্রিয়া আছে।
(৭) কোনো ধাতবপৃষ্ঠে এ রশ্মি পতিত হলে তা থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়। সুতরাং এ রশ্মির আলোকতড়িৎ ক্রিয়া আছে।
(৮) জিঙ্ক সালফাইড, বেরিয়াম-প্লাটিনোসায়ানাইড প্রভৃতি পদার্থে এ রশ্মি প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে।
(৯) এটা আয়ন সৃষ্টিকারী বিকিরণ। গ্যাসের মধ্য দিয়ে যাবার সময় এটা গ্যাসকে আয়নিত করে।
(১০) এটি আধান নিরপেক্ষ।
এক্স-রের বিভিন্ন ব্যবহার রয়েছে। এ রশ্মি চিকিৎসাবিজ্ঞানে, শিল্প কারখানায় ও গোয়েন্দাদের কাজে ব্যবহৃত হয়।
১। স্থানচ্যুত হাড়, হাড়ে দাগ বা ফাটল, ভেঙে যাওয়া হাড়, শরীরে বাইরের কোনো বস্তুর বা ফুসফুসের কোনো ক্ষতের ইত্যাদির অবস্থান নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
২। ক্যানসারের চিকিৎসা ও সংক্রমণ বৃদ্ধির চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় ।
৩। পরিপাক নালী দিয়ে খাদ্যবস্তুর গমন অনুসরণ, আলসার ও দাঁতের গোড়ায় আলসার নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হয়।
১। ধাতব ঢালাইয়ের দোষ-ত্রুটিপূর্ণ ওয়েল্ডিং, ধাতব পাতের গর্ত ইত্যাদি নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
২। কেলাস গঠন পরীক্ষায় এক্স-রে ব্যবহৃত হয় এবং মনিকারেরা এর সাহায্যে আসল ও নকল গহনা শনাক্ত করতে পারেন।
৩। টফি, লজেন্স ইত্যাদির মান বজায় আছে কিনা বা টফি ও লজেন্সে ক্ষতিকর কোনো কিছু মিশ্রিত হয়েছে কি না তা জানার জন্য ব্যবহৃত হয়।
১। কাঠের বাক্স বা চামড়ার থলিতে বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখলে তা খুঁজে বের করতে ব্যবহার করা হয় ।
২। কাস্টম কর্মকর্তারা চোরাচালানের দ্রব্যাদি খুঁজে বের করতে ব্যবহার করেন। কোনো নিষিদ্ধ পণ্য
কোনো কাঠের বাক্স বা ধাতুর বাক্সে থাকলে এদের মধ্য দিয়ে এক্স-রে প্রবেশ করিয়ে তা জানা যায়।
এক্স-রের একক রন্টজেন (Roentgen)। যে পরিমাণ এই -রে প্রতি কিলোগ্রাম বায়ুতে 2.58 x 10-4 কুলম্ব আধান উৎপন্ন করতে পারে তাকে এক রন্টজেন বলে ।
আলোক রশ্মি যখন কোনো ধাতবপৃষ্ঠে আপতিত হয় তখন ধাতবপৃষ্ঠের ইলেকট্রন আলোক রশ্মি থেকে শক্তি গ্রহণ করে। যখনই ইলেকট্রন দ্বারা গৃহীত শক্তি ধাতবপৃষ্ঠে তার বন্ধন শক্তির চেয়ে বেশি হয়, তখনই ইলেকট্রন ধাতবপৃষ্ঠ থেকে মুক্ত হয় বা বেরিয়ে আসে। এ ঘটনাকে ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া বা আলোক তড়িৎ ক্রিয়া বলা হয়। ইলেকট্রন নিঃসরণের জন্য ধাতবপৃষ্ঠে যথোপযুক্ত কম্পাঙ্কের আলো ফেলতে হয় তা না হলে ইলেকট্রন নিঃসরণ হয় না । যথোপযুক্ত উচ্চ কম্পাঙ্কবিশিষ্ট আলোক রশ্মি কোনো ধাতবপৃষ্ঠে আপতিত হলে তা থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়, এ ঘটনাই ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া বা আলোক তড়িৎ ক্রিয়া নামে পরিচিত। ধাতবপৃষ্ঠ থেকে নিঃসৃত ইলেকট্রনকে ফটোইলেকট্রন বলা হয় ।
কর্মকাণ্ড : ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া প্রদর্শনের একটি পরীক্ষা বর্ণনা কর । পরীক্ষা : ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক পর্যালোচনার জন্য যে পরীক্ষা করা হয় তা নিচে বর্ণনা করা হলো। [চিত্র ৮.৯]। চিত্রে কোয়ার্টজ নির্মিত বায়ুশূন্য নলে দুটি ধাতবপাত A ও C আছে। পাত দুটিকে বাইরের একটি | বর্তনীর সাহায্যে একটি ব্যাটারি B, রোধ R ও মিলিঅ্যামিটার mA-এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। পাত দুটির বিভব | পার্থক্য মাপার জন্য বর্তনীতে একটি ভোল্টমিটার V সংযুক্ত আছে। A পাতটি ব্যাটারির ঋণাত্মক প্রান্তের সাথে সংযুক্ত। এখন আলোক রশ্মি A-এর উপর আপতিত হলে A ও C এর মধ্যে তড়িৎ প্রবাহের সূচনা হবে মিলিঅ্যামিটার | দিয়ে যা পরিমাপ করা যাবে। এখন পাত দুটির মধ্যে বিভব পার্থক্য ক্রমশ বাড়াতে থাকলে তড়িৎ প্রবাহও বাড়তে থাকবে। কিন্তু বিভব পার্থক্যের একটা নির্দিষ্ট মানের জন্য এই প্রবাহ আর বাড়বে না। একটা নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ মানে এসে স্থির হয়ে যাবে। কোনো নির্দিষ্ট বিভব পার্থক্যের জন্য তড়িৎ প্রবাহের এই নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ মানকে 'সম্পৃক্তি প্রবাহ' (saturation current) | বলে। কিন্তু যদি পাত A-কে সামান্য ধনাত্মক বিভবে এবং C-কে ঋণাত্মক বিভবে রেখে A পাতের উপর একটা নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলো আপতিত হতে দেওয়া হয় তাহলে নির্গত ইলেকট্রনের মধ্যে ধীর গতিসম্পন্নগুলো C-তে না পৌঁছে পুনরায় A-তে ফিরে আসে। A ও C এর মধ্যে বিভব পার্থক্য ক্রমশ বৃদ্ধি করতে থাকলে আলোক তড়িৎপ্রবাহ ক্রমশ কমতে থাকবে এবং এক | সময় A-এর কোনো নির্দিষ্ট ধনাত্মক বিভবের জন্য তড়িৎ প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাবে। কোনো একটা নির্দিষ্ট ধাতব পদার্থের জন্য A-এর এই ধনাত্মক বিভবকে প্রতিরোধক বিভব বা নিবৃত্তি বিভব (stopping potential) বলে। এই নিবৃত্তি বিভবে সবচেয়ে শক্তিশালী | ইলেকট্রনগুলোও A-তে ফিরে আসে। এই সময় আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি করলেও কোনো ইলেকট্রন C-তে পৌঁছতে পারে না। এই বিভব পার্থক্যকে ইলেকট্রনের আধান দ্বারা গুণ করলে ইলেকট্রনের সর্বাধিক গতিশক্তি পাওয়া যায়। অর্থাৎ Kmax= eVo বা, = eVo এখানে, m = ইলেকট্রনের ভর Vm = ইলেকট্রনের সর্বাধিক বেগ e = ইলেকট্রনের আধান এবং Vo = নিবৃত্তি বিভব পুনরায় যদি A-কে ঋণাত্মক ও C-কে ধনাত্মক করে আলোর কম্পাঙ্ক অপরিবর্তিত রেখে তীব্রতা ক্রমশ বাড়ানো | হয় তাহলে দেখা যাবে যে নিবৃত্তি বিভবের মান সব সময় একই থাকছে কিন্তু তড়িৎ প্রবাহের মান বৃদ্ধি পাবে। আবার আলোর তীব্রতা একই রেখে কম্পাঙ্ক পরিবর্তন করলে দেখা যাবে যে, কম্পাঙ্ক যতই বাড়ানো হয়, নিবৃত্তি | বিভব ততই বেড়ে যায় কিন্তু তড়িৎপ্রবাহের কোনো পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ কম্পাঙ্ক বৃদ্ধির সাথে সাথে ফটো | ইলেকট্রনের সর্বোচ্চ গতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। আবার কম্পাঙ্ক হ্রাস করলে দেখা যায় যে, কোনো একটি নিম্নতম কম্পাঙ্কে | ঐ ধাতু থেকে কোনো ইলেকট্রন নিঃসৃত হয় না। উক্ত ন্যূনতম কম্পাঙ্ককে ঐ ধাতুর ছেদন কম্পাঙ্ক বা সূচন কম্পাঙ্ক fo বলে। |
১। ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা । ধাতবপৃষ্ঠে আলো আপতিত হওয়া এবং তা থেকে ইলেকট্রন নিঃসরণের মধ্যে কোনো কাল বিলম্বন (time lag) নেই। আলোর তীব্রতা যত কমই হোক না কেন যথোপযুক্ত কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট আলোক রশ্মি ধাতবপৃষ্ঠে আপতিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃষ্ঠ থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয় এবং আলো বন্ধ হওয়া মাত্র ইলেকট্রন নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যায়।
২। ফটোইলেকট্রনের গতিশক্তি আপতিত আলোর কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল কিন্তু আলোর তীব্রতার ওপর নির্ভরশীল নয়।
৩। যে কোনো নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক এবং মন্দনক বিভব পার্থক্যের জন্য ফটোপ্রবাহ I (Photo current) আপতিত আলোর তীব্রতার সমানুপাতিক অর্থাৎ আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ফটোপ্রবাহ বৃদ্ধি পায় এবং আলোর তীব্রতা হ্রাস পেলে ফটোপ্রবাহ হ্রাস পায়।
৪। প্রতি ধাতুর বেলায় একটি নিম্নতম কম্পাঙ্ক আছে, আপতিত আলোর তীব্রতা যাই হোক না কেন তার কম্পাঙ্ক এই নিম্নতম কম্পাঙ্ক থেকে বেশি না হলে ঐ ধাতু থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয় না। এটাকে ধাতুর সূচন কম্পাঙ্ক fo বলে।
ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়ার পরীক্ষালব্ধ ফলগুলোকে আমরা এখানে চিরায়ত তরঙ্গ তত্ত্ব অনুসারে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করব।
১। চিরায়ত তরঙ্গ তত্ত্ব অনুসারে কোনো ধাতবপৃষ্ঠে আলোর পতন ও তা থেকে ইলেকট্রন নিঃসরণের জন্য সময়ের প্রয়োজন, এ সময় কয়েকদিন পর্যন্ত হতে পারে। কেননা, ধাতবপৃষ্ঠে যে আলো শক্তি আপতিত হয়, পৃষ্ঠের ইলেকট্রনগুলো সেই শক্তি শোষণ করে উত্তেজিত হয়। যখন ইলেকট্রনগুলো শক্তি শোষণ করে তাদের বন্ধশক্তি বা তার চেয়ে বেশি শক্তি অর্জন করে তখনই ধাতব পৃষ্ঠ থেকে মুক্ত হয়। আর তার জন্য যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু উপরিউক্ত সমীকরণকে ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া সম্পর্কিত আইনস্টাইনের সমীকরণ বলা হয়। কোনো ধাতবপৃষ্ঠ থেকে নিঃসরণের জন্য ইলেকট্রনের একটি ন্যূনতম শক্তি প্রয়োজন, তা না হলে আলোর অনুপস্থিতিতে ইলেকট্রন ধাতবপৃষ্ঠ থেকে বেরিয়ে পড়ত। ন্যূনতম শক্তি hfo কে ধাতবপৃষ্ঠের কার্যাপেক্ষক (work function) বলা হয়। এটা ধাতব পৃষ্ঠের ওপর নির্ভরশীল। কার্যাপেক্ষককে সাধারণত ইলেকট্রন ভোল্ট এককে প্রকাশ করা হয়।
সুতরাং (8:43) নং সমীকরণকে লেখা যায়,
কোয়ান্টামশক্তি = ইলেকট্রনের সর্বাধিক শক্তি + পৃষ্ঠের কার্যাপেক্ষক
hf= Kmax + …(8.44)
এখানে = hfo = কার্যাপেক্ষক
১। কোয়ান্টাম তত্ত্বানুযায়ী একটি ফোটনের সাথে কেবলমাত্র একটি ইলেকট্রনেরই সংঘর্ষ হয় এবং ইলেকট্রন তার গৃহীত শক্তির ভাগ অন্যান্য ইলেকট্রনকে দেয় না। সুতরাং এই সংঘর্ষে শক্তি সংরক্ষিত থাকে এবং একে স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষ বলে। স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষে শক্তির তাৎক্ষণিক হস্তান্তর হয় বলে আলোক রশ্মির আপতন ও ইলেকট্রন নির্গমন এই দুইয়ের মাঝে কোনো কাল বিলম্বন (time lag) ঘটে না। সুতরাং ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা।
২। কার্যাপেক্ষক = hfo যেহেতু একটি ধ্রুবরাশি সুতরাং hf = Kmax + p সমীকরণ থেকে দেখা যায় যে, Kmax = hf - । এ থেকে সহজে বোঝা যায় যে, ইলেকট্রনের গতিশক্তি আলোর কম্পাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল । কম্পাঙ্ক f এর বৃদ্ধির সাথে গতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।
৩। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনুযায়ী আলো যেহেতু পৃথক পৃথক কোয়ান্টামের সমষ্টি এবং f কম্পাঙ্কবিশিষ্ট আলোর জন্য প্রত্যেক ফোটনের শক্তি hf সেহেতু আলোর তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ফোটনের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ফটোতড়িৎ প্রবাহ বাড়ে। কিন্তু আলোর কম্পাঙ্ক অপরিবর্তিত থাকায় ফোটনের শক্তি বৃদ্ধি পায় না এবং ইলেকট্রনের বেগ অপরিবর্তিত থাকে । সুতরাং কোয়ান্টাম তত্ত্ব পরীক্ষালব্ধ ফলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
৪। আলোর কম্পাঙ্ক f এর মান হ্রাস পেতে থাকলে ইলেকট্রনের বেগ হ্রাস পায় এবং একটি ন্যূনতম কম্পাঙ্ক fo এর জন্য বেগ শূন্য হয়ে যায়, ফলে কোনো ফটোইলেকট্রন নিঃসৃত হয় না। সুতরাং প্রত্যেক ধাতুর জন্য একটি সূচন কম্পাঙ্ক থাকে এবং তার মান, fo = / h.
তাড়িতচৌম্বক বিকিরণের দুটো প্রকৃতি তরঙ্গ প্রকৃতি ও কণা প্রকৃতি। তাড়িতচৌম্বক বিকিরণ তরঙ্গ আকারে সঞ্চালিত হয় ধরে নিলে তার প্রতিফলন, প্রতিসরণ, অপবর্তন ও ব্যতিচার ধর্ম সম্পর্কিত পরীক্ষাসমূহ ব্যাখ্যা করা যায়। ফটোইলেকট্রিক ক্রিয়া ও কম্পটন প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করতে হলে ধরে নিতে হয় যে, আলো কণারূপী ফোটনের সমষ্টি এবং প্রতি ফোটনের শক্তি E ও ভরবেগ । কণারূপী ফোটনকে এর কম্পাঙ্ক f এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্য দ্বারা যথার্থভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে।
প্রকৃতি নিজেকে বস্তু এবং বিকিরণ হিসেবে প্রকাশ করে। আবার প্রকৃতি প্রতিসাম্য (symmetry) পছন্দ করে। যেহেতু বিকিরণের দ্বৈত প্রকৃতি রয়েছে তাই বস্তুরও দ্বৈত প্রকৃতি থাকা সম্ভব। এ চিন্তা মাথায় নিয়ে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী লুইস দ্য ব্রগলি প্রস্তাব করেন যে, প্রত্যেক বস্তুরও দ্বৈত প্রকৃতি রয়েছে—একটি কণা প্রকৃতি এবং অপরটি তরঙ্গ প্রকৃতি । প্রত্যেকটি চলমান কণার সাথে একটি তরঙ্গ যুক্ত থাকে। প্রস্তাবকের নাম অনুসারে এই তরঙ্গকে দ্য ব্রগলি বস্তু তরঙ্গ বলা হয়। এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে দ্য ব্রগলি তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে ।
আমরা জানি যে, f কম্পাঙ্কবিশিষ্ট ফোটনের শক্তি E হলে,
E = hf
:-f=E/h... (8.46)
আপেক্ষিকতা তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়,
E = pc
বা, hf = pc
বা, p = hf/c
বা, p=h/
:- = h/p… (8.47)
(8.46) ও (8.47) সমীকরণ দুটোতে fও এর যথাযথ অর্থ তখনই প্রকাশ পায় যখন তাদের দ্বারা কোনো তরঙ্গকে বর্ণনা করা হয় । সমীকরণ দুটো থেকে এটাও স্পষ্ট বোঝা যায় যে, h, E ও p কোনো কণার সাথে সম্পর্কযুক্ত। সমীকরণ দুটো থেকে আরো বোঝা যায় যে, তাড়িতচৌম্বক বিকিরণের তরঙ্গকণা দ্বৈতরূপ (wave particle duality) আছে। এখানে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ধ্রুবরাশি, প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক । এটাও এই বিকিরণের তরঙ্গ প্রকৃতির এবং কণা প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এ থেকে আমরা বলতে পারি যে,
দ্য ব্রগলি অনুমান করেন যে (8.46 ) ও (8.47) নং সমীকরণ ইলেকট্রনের বেলায় যেমন প্রযোজ্য তেমনি সঠিক বিকিরণের বেলায়ও। এই অনুমান যদিও আশ্চর্যজনক তথাপি ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ডেভিসন এবং গারমারের পরীক্ষায় এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
দ্য ব্রগলির সম্পর্ক অনুসারে p ভরবেগবিশিষ্ট কোনো বস্তু কণার তরঙ্গদৈর্ঘ্য হবে,
= h/p =h/mv… (8.48)
এখানে h = প্ল্যাঙ্কের ধ্রুব, m = কণার ভর, v = কণার বেগ।
ইলেকট্রন দ্বারা এক্স-রে বিক্ষেপণের বেলায় মনে করা হতো যে বিক্ষিপ্ত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং আপতিত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য সমান থাকে। এ রকমের বিক্ষেপণকে রাদারফোর্ড বিক্ষেপণ বলা হয় এবং এর কাজ হলো আপতিত বিকিরণের দিক পরিবর্তন করা। ১৯২৩ সালে আর্থার কম্পটন উন্নতমানের যান্ত্রিক কৌশল দ্বারা প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, এক বর্ণের এক্স-রে 'হালকা মৌল' (যেমন কার্বন) দ্বারা বিক্ষিপ্ত হলে, বিক্ষিপ্ত বিকিরণ দুটো উপাংশে বিভক্ত হয়ে যায়।
একটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য আপতিত বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সমান থাকে, দ্বিতীয়টির তরঙ্গদৈর্ঘ্য আপতিত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে কিছুটা বেশি হয়। এ ঘটনাকে কম্পটন ক্রিয়া বলা হয় । আপতিত বিকিরণের অভিমুখের সাপেক্ষে বিক্ষিপ্ত বিকিরণ যদি কোণ উৎপন্ন করে বিক্ষিপ্ত হয় এবং ও ' যদি আপতিত ও বিক্ষিপ্ত বিকিরণের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হয় তাহলে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পার্থক্য হয়,
এখানে mo ইলেকট্রনের নিশ্চল ভর, h প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক এবং c আলোর বেগ ।
পদার্থের দ্বৈত প্রকৃতি 'ৰুণা প্রকৃতি' এবং 'তরঙ্গ প্রকৃতি' এর ধারণা থেকে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফল পাই । চিরায়ত বলবিজ্ঞানের মতে যে কোনো গতিশীল কণার অবস্থান এবং ভরবেগ থাকে এবং নীতিগতভাবে এগুলোকে নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা যেতে পারে। যেহেতু তরঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, সুতরাং তরঙ্গরূপী ইলেকট্রনের অবস্থান নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বভাবতই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে, কখনো তরঙ্গরূপী আবার কখনো কণারূপী ইলেকট্রনের অবস্থান কোনো নির্দিষ্ট স্থানে কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তে জানা সম্ভব কিনা?
হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি থেকে এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যায়। অনিশ্চয়তা নীতি বলে যে, কোনো কণার অবস্থান এবং ভয়পে নির্ভুলভাবে যুগপৎ পরিমাপ করা যায় না। একমাত্র নিম্নোক্ত সম্পর্ক দ্বারা সীমাবদ্ধ নির্ভুলতাসহ এ রাশিগুলোর মান নির্ণয় করা যেতে পারে।
… (8.60)
এখানে এবং যথাক্রমে অবস্থান ও ভরবেগ নির্ণয়ে অনিশ্চয়তার পরিমাণ। কোনো বন্ধুর শক্তি এবং সময়ের বেলায়ও এই সম্পর্ক খাটে। তাই দেখা যায়,
… (8.61)
সমীকরণ (8.60) এর অর্থ হলো, বস্তুর অবস্থান যতো বেশি নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যায় তার ভরবেগ তত কম নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যাবে। আবার বেশি নির্ভুলভাবে ভরবেগ নির্ণয় করতে হলে কম নির্ভুলভাবে অবস্থান নির্ণয় করতে হবে। সমীকরণ (8.61) থেকে বোঝা যায় যে, যত বেশি নির্ভুলভাবে কোনো পারমাণবিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় নির্ণয় করা যায়, তত কম নির্ভুলভাবে ঐ ঘটনা (পারমাণবিক ব্যবস্থা) এর শক্তি নির্ণয় করা যায়। অন্য কথায়, কোনো পারমাণবিক ব্যবস্থায় শক্তির মান যত নির্ভুলভাবে নির্ণয় করা যাবে ঠিক তত কম নির্ভুলভাবে ঐ পারমাণবিক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সময় নির্ণয় করা যাবে।
আরও দেখুন...